মাছ বা চিংড়ি মৃত্যুর পর যে প্রক্রিয়ায় বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যগুলো যেমন- স্বাভাবিক গঠন, স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ ইত্যাদির অবনতি ঘটে তাকে পচন ক্রিয়া বলে। পচন সংঘটিত হয় মূলত অণুজীবের কর্মতৎপরতা ও দেহ অভ্যন্তরস্থ জৈব পদার্থে বিদ্যমান এনজাইমের বিক্রিয়ার ফলে। মাছ বা চিংড়ি মৃত্যুর পর তার পেশীতে পর্যায়ক্রমে সংঘটিত জটিল রাসায়নিক পরিবর্তনের ফলে দেহ শক্ত হয়ে যাওয়ার পরপরই পচন শুরু হয়। চিংড়ি আহরণ করার পর এবং প্রক্রিয়াজাত করার পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মাঝে নিম্নলিখিত কারণে চিংড়ির পচন হয়ে থাকে।
ক. এনজাইমের বিক্রিয়া ঘটিত পচন: জীবিত অবস্থায় যেসব এনজাইম বিপাকীয় কাজে সহায়তা করে সেগুলো মাছ/চিংড়ির মৃত্যুর পর দেহ অভ্যন্তরস্থ কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও চর্বির ব্যাপক ভাঙ্গন ঘটায়, ফলে দেহে পচন শুরু হয়। এই পচনকে স্বয়ংক্রিয় পচনও বলা হয়। এনজাইমের বিক্রিয়ার ফলে পেশী দুর্বল হয়ে যায়, ফলে ব্যাক্টেরিয়ার কর্মতৎপরতা বৃদ্ধির জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়। এনজাইমের বিক্রিয়ার ফলে পেশীর প্রোটিন ভেঙ্গে বিভিন্ন এসিড ও নাইট্রোজেন ঘটিত পদার্থে রূপান্তরিত হয়, যা থেকে পরবর্তীতে বিভিন্ন দূর্গন্ধ সৃষ্টিকারী পদার্থ উৎপন্ন হয়।
খ. র্যানসিডিটি চর্বিযুক্ত মাছের ক্ষেত্রে এ ধরনের রাসায়নিক পচন হয়ে থাকে। মাছ/চিংড়ির চর্বি অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড দ্বারা গঠিত হওয়ায় বাতাসের অক্সিজেনের উপস্থিতিতে এগুলো জারিত হয়। এর ফলে মাছ বিবর্ণ হয়ে যায় এবং মাছ বা চিংড়ির স্বাদ বা গন্ধ অগ্রহণযোগ্য হয়ে যায়। বিশুদ্ধ লবণ ব্যবহার করে চর্বিযুক্ত মাছ বা চিংড়ির র্যানসিডিটি কমানো যায়।
গ. ব্যাক্টেরিয়ার কর্মতৎপরতা ঘটিত পচন: তাজা মাছের দেহে কোন ব্যাক্টেরিয়া না থাকলেও মাছ বা চিংড়ি ফুলকা, অন্ত্র ও ত্বৰ্কীয় শ্লেষ্মায় প্রচুর পরিমাণে ব্যাক্টেরিয়া থাকে। এই ব্যাক্টেরিয়া মাছ বা চিংড়ির পচনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। জলীয় পরিবেশ ব্যাক্টেরিয়ার ক্রমবিকাশের জন্য একটি উত্তম মাধ্যম। ফলে মাছ বা চিংড়ি আহরণের সময়েই ব্যাক্টেরিয়া দেহের বিভিন্ন অংশে আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। প্রকৃতিগতভাবেই মাছ বা চিংড়ি জীবিত অবস্থায় ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে দেহে একটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বজায় রাখে, যা মৃত্যুর পর আর কার্যকর থাকে না। ফলে দেহ অভ্যন্তরস্থ এনজাইমের স্বয়ংক্রিয় বিক্রিয়ার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পেশী ব্যাক্টেরিয়ার প্রবেশ উপযোগী হয় এবং বংশবৃদ্ধির জন্য অনুকূল পরিবেশ লাভ করে। মাছ বা চিংড়ির দেহস্থিত ব্যাক্টেরিয়া ছাড়াও অবতরণ কেন্দ্র ও আহরণোত্তর পরিচর্যাকালীন সময়ে প্রচুর ব্যাক্টেরিয়া মাছ বা চিংড়ির দেহে প্রবেশ করে। মাছ বা চিংড়ির দেহে পচন সৃষ্টিকারী ব্যাক্টেরিয়াগুলো হলো- এ্যারোমোব্যাক্টর, সিউডোমোনাস, মাইক্রোকক্কাস ইত্যাদি।
পচন রোধের উপায়সমূহ
১. অণুজীব কর্তৃক সৃষ্ট পচনকে বাধা দেয়ার জন্য নিম্নল্লিখিত কার্যক্রমগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে-
ক) অণুজীবকে চিংড়ি বা খাদ্যে ঢুকাতে না দেওয়া বা দূরে রাখা।
খ) অণুজীবকে অপসারণ করা।
গ) অণুজীবের বৃদ্ধি বা কার্যাবলীতে বাধা প্রদান বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা। যেমন- খুব ঠান্ডা করে বা শুষ্ক করে এনেরোবিক অবস্থা সৃষ্টি করে (অক্সিজেনের অভাব ঘটিয়ে), রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে ইত্যাদি।
২. চিংড়ির স্বপচন (self decomposition) বন্ধকরণের লক্ষ্যে নিচের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে
ক) ড্রেসিং-এর মাধ্যমে পরিপাকীয় এনজাইমের অপসারণ।
খ) সত্যিকারের রাসায়নিক বিক্রিয়াকে বাধা দেয়া বা বিলম্ব করা।
গ) চিংড়ির এনজাইমকে ধ্বংস করে বা সম্পূর্ণভাবে নিস্ক্রিয় করে।
ঘ) পোকা মাকড়, অন্যান্য প্রাণী, যান্ত্রিক কারণ ইত্যাদির ফলে খাদ্য বিনষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে।
নিম্ন তাপমাত্রায় মাছ বা চিংড়ি সংরক্ষণ তাপমাত্রার ওপর ভিত্তি করে নিম্ন তাপমাত্রায় মাছ বা চিংড়ি সংরক্ষণ পদ্ধতিকে দু'ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
ক) শীতলীকরণ: এ প্রক্রিয়ায় মাছ বা চিংড়ির দেহের তাপমাত্রা ০ (শূন্য) ডিগ্রি সে. এর কাছাকাছি আনা হয় এবং সপ্তাহখানেক পর্যন্ত মাছ বা চিংড়ির গুণগতমান ভাল অবস্থায় থাকে।
খ) হিমায়িতকরণ: এ প্রক্রিয়ায় মাছ বা চিংড়ির দেহের তাপমাত্রা মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সে. থেকে মাইনাস ৪০
ডিগ্রি সে. এর কাছাকাছি রাখা হয় এবং মাছ বা চিংড়ির গুণগতমান ৬ থেকে ২৪ মাস পর্যন্ত ভাল
অবস্থায় থাকে।
ক. শীতলীকরণ প্রক্রিয়ায় চিংড়ি সংরক্ষণ
চিলিং বা শীতলীকরণ এমন একটি পদ্ধতি যে পদ্ধতিতে চিংড়ির দেহের তাপমাত্রা কমিয়ে হিমায়ন বিন্দুর প্রায় কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়। তবে কখনই এর নিচে নয়। হিমায়ন বিন্দু বিভিন্ন প্রজাতিতে ০.৬ থেকে ২ ডিগ্রি সে. এর মধ্যে পরিবর্তিত হয়। তবে সচরাচর একে ১ ডিগ্রি সে. ধরা হয়।
অতি শীতলীকরণ (Supper Chilling): চিংড়ির দেহের তাপমাত্রা কমিয়ে হিমায়ন বিন্দুর ঠিক নিচের তাপমাত্রায় নিয়ে আসাকে অতি শীতলীকরণ বুঝায়। এখানে চিংড়ির মাংস হিমায়িত হতে শুরু করে।
চিলিং এর উদ্দেশ্য
চিলিং সাধারণত চিংড়ি বা অন্য কোন খাদ্যদ্রব্য স্বল্প সময়ের জন্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। কারণ এটি
ক) অনুজীবের বৃদ্ধির হারকে কমিয়ে দেয়।
খ) চিংড়ির মৃত্যুর পর বিভিন্ন বিপাকীয় কার্যাবলীকে হ্রাস করে।
গ) রাসায়নিক কর্মকান্ডের ফলে চিংড়ির পচনকে রোধ করে।
চিলিং বা শীতলীকরণ পদ্ধতি
চিংড়ি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে শীতলীকরণ সবচেয়ে পরিচিত সংরক্ষণ পদ্ধতি। সাধারণত চিংড়িকে স্বল্প সময়ের জন্য সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে শীতলীকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। সাধারণত নিম্নোক্ত পদ্ধতির মাধ্যমে চিলিং করা হয়। যথা-
১. বরফের সাহায্যে শীতলীকরণ (Chilling with Ice )
বরফ একটি আদর্শ শীতলীকরণ মাধ্যম। একটি নির্দিষ্ট ওজনের বা আয়তনের বরফের ঠান্ডাকরণ ক্ষমতা খুব বেশি নিরাপদ, তুলনামূলকভাবে সস্তা এবং চিংড়ির ঘনিষ্ট সংস্পর্শে এসে চিংড়িকে দ্রুত শীতল করে। কার্যকর শীতলীকরণের জন্য বরফকে অবশ্যই গলতে দিতে হবে। অধিকন্তু গলিত বরফ চিংড়িকে আর্দ্র ও চকচকে রাখে।
আমরা জানি, পানি থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ তাপ সরিয়ে নিলে পানি বরফে পরিণত হয় এবং একই পরিমাণ তাপ যোগ করা হলে বরফ পুনরায় পানিতে পরিণত হয়। কঠিন অবস্থা থেকে তরল অবস্থায় আসতে যে পরিমাণ তাপ প্রয়োজন হয় তাকে সুপ্ত তাপ বলে। ১ কেজি বরফ গলতে ৮০ কিলোক্যালরি তাপের প্রয়োজন হয়। তাই ৮০ কিলোক্যালরি তাপমাত্রাকে বরফ গলনের সুপ্ততাপ বলে। বরফ গলতে বেশি তাপের প্রয়োজন হয় বলে এটি ভালো ঠান্ডাকরণ বাহক হিসেবে কাজ করে। এখানে উল্লেখ্য, ১ কেজি পানির তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সে. বৃদ্ধি করতে যে পরিমাণ তাপের প্রয়োজন হয় সেই পরিমাণ তাপকে ১ কিলোক্যালরি বলা হয়।
পানির আপেক্ষিক তাপ ১ এবং অন্যান্য পদার্থের আপেক্ষিক তাপ ১ অপেক্ষা কম। নিম্নে কয়েকটি পদার্থের আপেক্ষিক তাপ উল্লেখ করা হলো।
চিত্র ৫.৮: বরফের সাহায্যে চিংড়ি শীতলীকরণ
বরফ কিভাবে চিংড়িকে ঠান্ডা করে: শীতলীকরণ করার জন্য যখন বরফকে চিংড়ির সংস্পর্শে রাখা হয়, তখন গরম বা উষ্ণ চিংড়ি থেকে তাপ বরফে স্থানান্তরিত হয়। এভাবে চিংড়ির তাপমাত্রা কমতে থাকে এবং বরফ গলতে থাকে। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ চিংড়িকে শীতল করার জন্য কি পরিমাণ তাপ অপসারণ করতে হবে এবং কি পরিমাণ বরফ প্রয়োজন তা সহজেই হিসাব করা যায়।
কোন পদার্থ ঠান্ডা হতে কি পরিমাণ তাপ বর্জন করে তা আপেক্ষিক তাপ ব্যবহার করে বের করা যায়। যেমন- বর্জিত তাপ= বস্তুর ওজন x তাপমাত্রার পার্থক্য x আপেক্ষিক তাপ
উদাহরণ: ১০ কেজি মাছ যার তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সে. এবং মাছের আপেক্ষিক তাপ ১। এখন ১০ কেজি মাছকে ২৫ ডিগ্রি সে. থেকে ০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ঠান্ডা হতে বর্জিত তাপ হলো- = কিলোক্যালরি, কিন্তু ১ কেজি বরফ গলতে ৮০ কিলোক্যালরি তাপ গ্রহণ করে। সুতরাং ১০ কেজি মাছ ঠান্ডা হতে ২৫০+৮০= ৩.১২ কেজি বরফ প্রয়োজন হবে।
বরফের প্রকারভেদ
ক) ব্লক আইস (Block ice): এটি মৎস্য শিল্পে ব্যবহৃত বরফের মধ্যে অন্যতম এবং বহুল পরিচিত। আমাদের দেশে এটি বেশি ব্যবহৃত হয়। প্রয়োজন অনুসারে একখন্ড বরফের ওজন ১২-১৫০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে বাজারের ওপর নির্ভর করে এর আকৃতি দেয়া হয়। চিংড়ি শীতলীকরণের জন্য ব্লক আইসকে গুঁড়ো করে ব্যবহার করা হয়।
খ) ফ্লেক আইস (Flake ice): এটি তুলার ন্যায় নরম। এটি খুব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বরফের গুঁড়ো, যা দেখতে পাউডারের ন্যায়।
গ) টিউব আইস (Tube ice): এ ধরনের বরফ একটা উলম্ব নলের ভিতরের পাত্রে তৈরি করা হয়, যা ফাঁপা সিলিন্ডার আকৃতির হয়ে থাকে। এর গুরুত্ব প্রায় ১০-১২ মিটার ও আকার ৫০×৫০ বর্গ মিমি. । নল থেকে বরফ বের করার পর একে বরফ কাটা নলের সাহায্যে সুবিধামত খন্ডে (সাধারণত ৫০ মিমি) কাটা হয়।
ঘ) প্লেট আইস (Plate ice): এটি দেখতে প্লেটের ন্যায়। একটি উলম্ব প্লেটের এক মুখে এ ধরনের বরফ তৈরি হয় এবং অপর মুখে পানি প্রবাহিত করে একে প্লেট থেকে বের করে আনা হয়। এই বরফের সর্বানুকূল পুরুত্ব হলো ১০-১৫ মিমি। তবে বরফ খন্ডের আকার পরিবর্তনশীল।
২. শীতল পানিতে চিংড়ি নিমজ্জনের মাধ্যমে এটি করা হয় মূলত দু'ভাবে-
ক) রেফ্রিজারেটেড সামুদ্রিক পানি ও
খ) শীতল সামুদ্রিক পানি ব্যবহার করে।
ক. রেফ্রিজারেটেড সামুদ্রিক পানি (Refrigerated Sea Water - RSW) এক্ষেত্রে সমুদ্রের পানিকে ঠান্ডা করে ব্যবহার করা হয়। সমুদ্রের পানিতে শতকরা ৩.৫ ভাগ লবণ থাকে। যদি সমুদ্রের পানিকে রেফ্রিজারেটেড করা হয় তাহলে সহজে তাপমাত্রা কমানো সম্ভব। এক্ষেত্রে তাপমাত্রা মাইনাস ২ ডিগ্রি সে. থেকে মাইনাস ১০ ডিগ্রি সে. পর্যন্ত সীমাবন্ধ থাকবে।
রেফ্রিজারেটেড সামুদ্রিক পানির সুবিধা-
১) খুব দ্রুত ঠান্ডা হয় কারণ এর ক্ষেত্রফল বেশি হয়।
২) চিংড়ির একটির উপর অন্যটিকে রেখে জড়তা কমিয়ে দেয়।
৩) নিম্ন তাপমাত্রায় জমাট বাধা সম্ভব।
৪) অল্প সময়ে, কম শ্রমে অধিক পরিমাণে চিংড়িকে দ্রুত পরিচর্যা করা যায়।
রেফ্রিজারেটেড সামুদ্রিক পানির অসুবিধা-
১) চিংড়ির দেহের মধ্যে অধিক পরিমাণে লবণ প্রবেশ করে, কারণ সমুদ্রের পানিতে অতিরিক্ত থাকে। ফলে প্রক্রিয়াজাত ও বাজারজাতকরণে অসুবিধা হয়।
২) চিংড়ির ওজন বেড়ে যায়, কারণ পানি ও লবণ দেহে প্রবেশ করে।
৩) প্রোটিনের পরিমাণ কমে যায় ।
৪) অল্প সময়েই অ্যানারোবিক হ্যালোফিলিক ব্যাক্টেরিয়া চিংড়ি পচাতে শুরু করে
খ. শীতল সামুদ্রিক পানি (Chilled Sea Water CSW)
সমুদ্রের পানির সাথে কিছু পরিমাণ বরফ মিশিয়ে এটা তৈরি করা হয়। এক্ষেত্রে কিছু ঠান্ডা আসে রেফ্রিজারেটর থেকে এবং কিছু আসে বরফ থেকে। এ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত চিংড়ি ও বরফের অনুপাত সাধারণত ৩:১ অথবা ৪:১ হয়ে থাকে। শীতল সামুদ্রিক পানি পদ্ধতিতে পর্যাপ্ত ঠান্ডা করার জন্য কী পরিমাণ বরফ প্রয়োজন তা সহজে নির্ণয় করা যায়। নিচে এ সম্পর্কিত হিসাব-নিকাশ দেওয়া হল।
ধরা যাক, ৮ টন বা ৮ হাজার কেজি চিংড়িকে ২৪ ডিগ্রি সে. থেকে মাইনাস ১ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ঠান্ডা করতে হবে এবং চিংড়ি ও বরফের অনুপাত হবে ৪:১। চিংড়ি ও পানির মিশ্রণের ফলে তাদের একত্রে ওজন হবে ১০ টন (১০ হাজার কেজি) এবং কি পরিমাণ তাপ বর্জন করবে তা নিচের সূত্রের সাহায্যে নির্ণয় করা যায়।
আমরা জানি, বরফ গলনের সুপ্ততাপ ৮০ কিলোক্যালরি।
এতএব প্রয়োজনীয় বরফের ওজন = ২৫০০০০+৮০= ৩১২৫ কেজি। অতএব মাইনাস ১.০ ডিগ্রি সে তাপমাত্রায় নিয়ে আসার জন্য ৩ টনের কিছু বেশি বরফ দরকার হবে।
৩. শীতলীকরণ কক্ষে চিংড়ির উপর দিয়ে ঠান্ডা বাতাস প্রবাহের মাধ্যমে-
ক) সমুদ্রে বরফ দিয়ে চিংড়ি শীতলীকরণ (Chilling of Fish with Ice at Sea),
খ) স্তুপাকারে শীতলীকরণ (Bulk Chilling) যেখানে চিংড়ি ধরা হয় এবং যে জলযানের মাধ্যমে চিংড়ি ধরা হয় তার উপর যে শীতলীকরণ করা হয় তাকে স্তুপাকারে শীতলীকরণ বলে। একটি উপযুক্ত ফিসরুম বিশিষ্ট ফিসিং ভেসেলে নিম্নরুপে চিংড়িকে মজুত করা হয়।
প্রথমে ফিসরুমের তলদেশ বরফ দিয়ে ১৯০ থেকে ১৯৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত গভীরভাবে আবৃত করে দিতে হয়। তবে বরফের গভীরতা বা পুরুত্ব নির্ভর করে ফিসরুমে ব্যবহৃত নিরোধক, জাহাজের দৈর্ঘ্য এবং সমুদ্রের পানির তাপমাত্রার উপর যদি ফিসরুম ধাতব পদার্থের তৈরি হয়। যদি মেঝে অন্তরিত (insulated) না হয়, তবে তলায় বরফের স্তরের পুরুত্ব বৃদ্ধি করা হয়। তখন এই বরফের স্তরের উপর চিংড়ি রাখতে হবে। তারপর আবার চিংড়ির উপর বরফের গুঁড়ো ছিটিয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে চিংড়ির মধ্যে বরফের গুঁড়ো থাকবে। প্রতিটি চিংড়ি একে অপরের সাথে লেগে থাকলে ঠান্ডা হতে যত সময় লাগবে তার চেয়ে কম সময় লাগবে যখন প্রতিটি চিংড়ি বরফের গুঁড়ো দিয়ে পৃথক থাকে। এরপর বরফের দ্বিতীয় স্তর দেওয়া হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত আগেরগুলো ভর্তি না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত গুঁড়ো বরফ ছিটিয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে বরফের সর্বশেষ যে স্তরটি হয় তার পুরুত্ব ৫ সেন্টিমিটার হতে হবে। প্রতি আধা মিটার পর পর বরফের সাপোর্ট দিতে হবে। চিংড়ির বাক্সে বা ফিসরুমে চিংড়ির স্তর বেশি হওয়া উচিত নয়। কারণ এতে অতিরিক্ত চিংড়ির চাপে তলার চিংড়ি ফেটে যেতে পারে এবং চিংড়ির দেহের তরল পদার্থ বের হয়ে আসতে পারে। ফলে চিংড়ি ওজনে কমে যেতে পারে।
বাক্স শীতলীকরণ (Box Chilling) : সমুদ্রের তীরে আসার পর বাক্সে চিলিং করা চিংড়ি স্তুপ করা চিংড়ির চেয়ে ভালো থাকে এবং ভূমিতে বা তীরে আসার পরও চিংড়ি সুরক্ষিত অবস্থায় থাকবে। এক্ষেত্রে বাক্সের ডিজাইন বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বাক্সটি এমন আকৃতির হতে হবে, যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ বরফসহ চিংড়ি ধারণ করতে পারে। এই অবস্থায় বরফ চিংড়িকে ভূমিতে আসা পর্যন্ত ঠান্ডা রাখে। আবার একইভাবে বাক্স প্রশস্ত হবে না যাতে একে নড়াচড়া করতে অসুবিধা হয়। বাক্সে এমনভাবে ড্রেনের ব্যবস্থা থাকতে হবে যাতে করে গলিত পানি গড়িয়ে বাক্সের একপাশে বা শেষ প্রান্তে এসে জমা হয়। বাক্সে চিংড়ি বোঝাই করার সময় বাক্সের তলায় প্রায় ৬ সেন্টিমিটার গভীর বরফের স্তর থাকে এবং শেষ স্তরের পুরুত্বও প্রায় ৫ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। বাক্সটি বেশি বোঝাই করা উচিত নয়, যাতে করে এটি ফেটে যেতে পারে।
সতর্কতা:
১. চিংড়ির স্তরের পুরুত্ব যেন বেশি না হয়। পুরুত্ব বেশি হলে ভিতরের চিংড়িগুলো ঠান্ডা হতে সময় বেশি লাগবে।
২. স্তূপাকার শীতলীকরণের সাহায্যে অতিরিক্ত স্তর দিতে হবে।
৩. বাক্স শীতলীকরণের দৈর্ঘ্য ২৫ সেন্টিমিটারের বেশি হওয়া উচিৎ নয়। এর চেয়ে বড় হলে পরিবহণে অসুবিধা হবে।
৪. শীতল পানিতে চিংড়ি নিমজ্জনের মাধ্যমে চিংড়িকে শীতল করা যায়।
শীতলীকরণের সময় চিংড়ির পরিবর্তন
ক) প্রোটিন ও ওজনে কম হওয়া: বরফ দিয়ে চিংড়ি শীতল করতে থাকলে চিংড়ির ওজন ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। ব্যাপকভাবে মুক্ত তরল ও ড্রিপ গঠনের (drip formation) কারণে হিমায়িত ফিলেট ও স্টেক (fillets and steaks) ওজনে কমে যায়। কারণ ড্রিপ গঠনের ফলে কিছু দ্রবণীয় প্রোটিন, লবণ ও অন্যান্য পুষ্টিকারক দ্রব্য দেহ থেকে বেরিয়ে আসে।
খ) বিবর্ণতা (Discoloration): চিলিংয়ের সময় চিংড়ির উপর বরফের অতিরিক্ত চাপের কারণে চিংড়ির ক্ষতি হয়। দেহ থেতলে যায়, গায়ে ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং বিবর্ণ হয়ে থাকে।
গ) পচনশীলতা (Rancidity): বরফ দিয়ে দীর্ঘদিন শীতলীকরণের জন্য পচা গন্ধ চিংড়ির গুণাগুণ নষ্ট করে দেয়।
ঘ) কুঞ্চিত হওয়া (Shrinkage): কুঁচকে যাওয়া একটি সাধারণ ঘটনা যা চিংড়ির বরফ দিয়ে প্যাকেট করার সময় ঘটে থাকে। বিশেষ করে উপরের স্তরে এটা ঘটে।
খ. হিমায়িতকরণ প্রক্রিয়ায় চিংড়ি সংরক্ষ
হিমায়িতকরণ হলো চিংড়ি সংরক্ষণের এমন একটি পদ্ধতি যাতে চিংড়ি দেহের প্রাথমিক তাপমাত্রাকে কমিয়ে মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সে. এর নিচে আনা হয়, ফলে চিংড়ির কলার বেশিরভাগ পানি জমে বরফে পরিণত হয়। এ ক্ষেত্রে প্রায় ৮৫ শতাংশ পানি বরফে রূপান্তরিত হয়। যদিও মাইনাস ৮ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় চিংড়িকে হিমায়িতকরণ করা হয় তথাপিও এনজাইমেটিক কর্মতৎপরতা মাইনাস ২০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা পর্যন্ত চলতে থাকে। ফলে চিংড়ির গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সম্ভাবনা থাকে। তাই চিংড়ির গুণগতমান ভাল রাখার জন্য মাইনাস ৩৫ ডিগ্রি সে. থেকে মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় চিংড়িকে ফ্রোজেন করা হয়। হিমায়িতকরণের আধুনিক পদ্ধতিতে দ্রুত দেহের তাপমাত্রা নিচে নেমে আসে এবং চিংড়ির দেহকলার অভ্যন্তরস্থ সর্বশেষ তাপমাত্রা হয় মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সে.।
হিমায়িতকরণের উদ্দেশ্য: হিমায়িতকরণের মাধ্যমে কোন একটি দ্রব্যের গুণগত মান অপরিবর্তিত রাখা হয়। নিম্নলিখিত কারণে চিংড়ির ফ্রিজিং বা হিমায়িত করা হয়ে থাকে। যথা-
১) অণুজীব দ্বারা খাদ্য বস্তুর পচনকে রোধ করে বা বাধা
২) এনজাইমের কার্যাবলীকে রোধ করে বা বাধা দেয়।
৩) রাসায়নিক বিক্রিয়া রোধ করে বা বাধা দেয়।
আংশিক হিমায়িতকরণ (Partial freezing): আংশিক হিমায়িতকরণ হলো চিলিং এবং হিমায়িতকরণ তাপমাত্রার মধ্যবর্তী একটি তাপমাত্রা অর্থাৎ যখন চিংড়ির দেহের তাপমাত্রাকে কমিয়ে মাইনাস ৩ ডিগ্রি সে. বা মাইনাস ৪ ডিগ্রি সে. এ আনা হয়, তখন তাকে আংশিক হিমায়িতকরণ বলে।
ফ্রোজেন (Frozen ): ফ্রোজেন হলো তাপমাত্রাকে কমিয়ে কমপক্ষে মাইনাস ৮ ডিগ্রি সে. থেকে মাইনাস ১০ ডিগ্রি সে. এ নিয়ে আসা।
ফ্রোজেন পণ্য (Frozen product): যখন কোন বস্তুর তাপমাত্রা কমিয়ে মাইনাস ৮ ডিগ্রি সে. থেকে মাইনাস ১০ ডিগ্রি সে. এর মধ্যে নিয়ে আসা হয়, তখন সেই বস্তুকে ফ্রোজেন পণ্য বলে ।
চিলিং স্টোরেজ (Chilling storage): চিংড়িকে হিমায়িতকরণ তাপমাত্রার উপরে রেখে গুদামজাত করাকে চিংড়ির চিলিং স্টোরেজ বলে। চিলিং স্টোরেজের ব্যাপক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। কারণ এটি স্বল্পমেয়াদী সংরক্ষণ পদ্ধতি হিসেবে খুবই ফলপ্রসু।
সারণি: চিলিং ও ফ্রিজিং এর মধ্যে পার্থক্য
ক্রম | চিলিং | ফ্রিজিং |
---|---|---|
০১ | তাপমাত্রা কমিয়ে ফ্রিজিং পয়েন্টের নিকট নিয়ে আসা | তাপমাত্রা কমিয়ে মাইনাস ৮ ডিগ্রি সে. থেকে মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সে. বা মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সে, এ নিয়ে আসা |
০২ | দেহস্থ পানির অণুগুলো বরফে পরিণত হয় না | দেহস্থ পানির অণুগুলো বরফে পরিণত হয় |
০৩ | এটি স্বল্পকালীন সংরক্ষণ পদ্ধতি | এটি দীর্ঘকালীন সংরক্ষণ পদ্ধতি |
০৪ | মাছ ধরার যান্ত্রিক যানে এর সুযোগ- সুবিধা থাকে | ট্রলারে ও মাদারশীপে সাধারণত এ সুযোগ সুবিধা থাকে |
০৫ | চিলিং সাধারণত বরফের মাধ্যমে করা হয় | ফ্রিজিং সরাসরি ফ্রিজারের মাধ্যমে করা হয় |
হিমায়িতকরণের শ্রেণিবিন্যাস হিমায়িতকরণ মূলত দু' প্রকার যথা-
ক) ধীরগতি হিমায়িতকরণ (slow freezing), এবং
খ) দ্রুত হিমায়িতকরণ (quick freezing)
ক) ধীরগতি হিমায়িতকরণ (slow freezing)
এ পদ্ধতিতে ধীরে ধারে চিংড়ির দেহ থেকে তাপমাত্রা কমিয়ে হিমায়িতকরণ তাপমাত্রায় নিয়ে আসা হয়। সাধারণত তাপমাত্রা কমিয়ে মাইনাস ২৫ ডিগ্রি সে. বা তার নিচে রাখা হয়। তাই এই তাপমাত্রা মাইনাস ১৫ ডিগ্রি সে. থেকে মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সে. বা নিচে রাখা হয়। হিমায়িতকরণ হতে সময় লাগে ৩ ঘন্টা থেকে ৭২ ঘন্টা।
ধীরগতি হিমায়িতকরণের সুবিধা
ধীরগতি হিমায়িতকরণের অসুবিধা
খ) দ্রুত হিমায়িতকরণ (Quick freezing )
এই পদ্ধতিতে দ্রুত চিংড়ির দেহের তাপমাত্রা কমিয়ে আনা হয়। এ ক্ষেত্রে হিমায়িতকরণের তাপমাত্রা সাধারণত মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সে. এবং হিমায়িতকরণ হতে ৩০ মিনিট বা তার চেয়ে কম সময় লাগে।
দ্রুত হিমায়িতকরণের সুবিধা
রেফ্রিজারেশন (Refrigeration) একটি বন্ধ ঘরে ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত করে চিংড়ি বা অন্য কোন খাদ্য দ্রব্যের তাপমাত্রা কমিয়ে তাদেরকে সংরক্ষণ করার পদ্ধতিকে রেফ্রিজারেশন বলে। |
হিমায়ক যন্ত্রের প্রকারভেদ (Types of freezer )
মাছ বা চিংড়ি হিমায়িতকরণের জন্য বিভিন্ন ধরনের হিমায়ক যন্ত্র বা ফ্রিজার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। নিচে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত কয়েকটি হিমায়ক যন্ত্রের বিবরণ দেয়া হলোঃ
১. এয়ার ব্লাস্ট ফ্রিজার (Air Blast Freezer ABF )
২. কন্টাক্ট প্লেট ফ্রিজার (Contact Plate Freezer CPF)
৩. ইমারসন ফ্রিজার (Immersion Freezer IF )
৪. সাপ ফ্রিজার (Sharp Freezer SF)
৫. অন্যান্য ফ্রিজার (Other Freezer )
১. এয়ার ব্লাস্ট ফ্রিজার (Air blast freezer )
যে হিমায়ক যন্ত্রের ভিতর দিয়ে ঠান্ডা বাতাসের বাষ্প প্রবাহিত করে চিংড়ি বা অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যকে হিমায়িতকরণ করা হয় তাকে এয়ার ব্লাস্ট ফ্রিজার বলে। এটি দু' প্রকার-
ক) সার্বক্ষণিক ফ্রিজার (Continuous freezer): এতে হিমায়িতকরণের সময় উৎপাদ (product) ঘুরতে থাকে। যেমন- হিমাগারের ভিতর এক পাশ দিয়ে চিংড়ি ঢোকানো হয় এবং অন্য পাশ দিয়ে বের করা হয়।
খ) ব্যাচ ফ্রিজার (Batch freezer): এর ভিতর উৎপাদ স্থির থাকে। যেমন- হিমাগারের ভিতর এক ব্যাচ চিংড়ি ঢুকিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে ধরে রেখে দেয়া হয়।
বাণিজ্যকভাবে ব্যবহৃত এয়ার ব্লাস্ট ফ্রিজারের হিমায়িতকরণ পদ্ধতি: এয়ার ব্লাস্ট ফ্রিজারে সাধারণত সুড়ঙ্গ পথযুক্ত একটি পৃথককৃত ঘর, যার মধ্যে ইভাপোরেটরের উপর দিয়ে এক বা একাধিক ফ্যানের মাধ্যমে উৎপন্ন বায়ু যাকে অ্যামোনিয়া (NH3), ঠান্ডা লবণ পানি অথবা রেফ্রিজারেন্ট (refrigerant) ১২ বা ২২ ঘন্টা দিয়ে ঠান্ডা করা হয়। যে দ্রব্যকে হিমায়িতকরণ করা হবে তার চারপাশে দিয়ে বায়ু প্রবাহিত করা হয়। এই ফ্রিজারের পৃথককৃত ঘরের মধ্যে সাধারণত একবারেই সম্পূর্ণরূপে সেলফের র্যাকে চিংড়ি ভর্তি করা হয়। প্রয়োজন অনুসারে র্যাককে ঘূর্ণায়মান অবস্থায় অথবা স্থির রাখা হয়। সাম্প্রতিককালে উন্নত ফ্রিজারে চিংড়ি উৎপাদকে সর্বক্ষণ নাড়াচাড়া করানোর জন্য কনভেয়ার ব্যবহার করা হয়। এই ধরনের অধিকাংশ ফ্রিজারে তাপমাত্রা মাইনাস ৩৫ ডিগ্রি সে. থেকে মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সে. এর মধ্যে রাখা হয়। অধিকাংশ অর্থনৈতিক সুবিধাজনক হিমায়িতকরণ করানোর জন্য উৎপাদের উপর দিয়ে এই ঠান্ডা বাতাস প্রবাহের গতি সাধারণত ৫০০-১০০০ এফপিএম (ফুট পার মিনিট) এর মধ্যে রাখা হয়। এরুপ ফ্রিজারের হিমায়িতকরণ করতে সময় লাগে ৬ থেকে ৮ ঘন্টা।
২. কন্টাক্ট প্লেট ফ্রিজার (Contact Plate Freezer CPF)
এই হিমায়ক যন্ত্রে চিংড়িকে প্লেটের উপর রেখে ধীরে ধীরে হিমায়িতকরণ করা হয়। এরুপ ফ্রিজারে চিংড়িকে ফাঁপা ধাতুর প্লেটের মধ্যে রাখা হয়, যার ভিতরে যে কোন একটি রেফ্রিজারেন্ট প্রবাহিত করানো হয়। এটি দু' প্রকার-
ক) আনুভূমিক কন্টাক্ট প্লেট ফ্রিজার এতে ট্রের মধ্যে বসানো চিংড়ির চ্যাপ্টা প্যাক ব্যবহার করা হয়।
খ) উলম্ব কন্টাক্ট প্লেট ফ্রিজার প্রধানত বড় ধরনের ব্লক তৈরি করার জন্য ব্যবহার করা হয়।
বাণিজ্যিক পদ্ধতি: কন্টাক্ট প্লেট ফ্রিজারের একটি কেবিনে বা ঘরের চলাচলক্ষম আনুভুমিক প্লেটগুলোর উলম্ভভাবে গাদা দেওয়া থাকে। প্লেটগুলোকে সংযুক্ত পথের মাধ্যমে ঠান্ডা লবণ পানি, NH3 বা রেফ্রিজারেন্ট ১২ বা ২২ ঘন্টা দিয়ে ঠান্ডা করার ব্যবস্থা থাকে। এই ধরনের ফ্রিজার গাটবন্দী (packaged) মৎস্য উৎপাদের জন্য উপযুক্ত। প্রতিটি ব্লক চিংড়িসহ ৫০-৬০ মিলিমিটার পর্যন্ত পুরু হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে ব্লকের তাপমাত্রা মাইনাস ৩৫ ডিগ্রি সে. হয়ে থাকে। মৎস্য উৎপাদকে তাড়াতাড়ি ফ্রিজিং করার জন্য এটি ব্যবহার করা হয়।
৩. ইমারসন ফ্রিজার (Immersion Freezer IF )
এ ক্ষেত্রে নিম্ন তাপমাত্রার তরল পদার্থ উৎপাদকে ডুবানো বা নিমজ্জন করা হয়। এ ধরনের ঠান্ডা তরল পদার্থের মধ্যে চিংড়িকে রেখে সরাসরি তার দেহের তাপমাত্রা কমানোর পদ্ধতি এয়ার ব্লাস্ট ফ্রিজারের ঠান্ডা বাতাস থেকে উৎকৃষ্ট। পানি থেকে এই ধরনের তরল পদার্থের ফ্রিজিং পয়েন্ট বেশি হয়ে থাকে।
৪. সার্প ফ্রিজার (Sharp Freezer SF)
সার্প ফ্রিজার একটি পৃথককৃত ঘর এবং সেখানকার তাপমাত্রা মাইনাস ২৫ ডিগ্রি সে রাখা হয়। এখানে একাধিক পাইপের কয়েল দিয়ে তৈরি সেলফ রাখা হয়। যার ভিতর দিয়ে ঠান্ডা লবণ পানি, NH, অথবা অন্যান্য রেফ্রিজারেন্টকে প্রবাহিত করা হয়। এই পদ্ধতিতে চিংড়িকে হিমায়িতকরণের সময় সরাসরি সেলফে রক্ষিত প্লেটের উপর রাখা হয়। এই পদ্ধতিতে উৎপাদের সব অংশ পাইপের সংস্পর্শে থাকতে পারে না। এই পদ্ধতি অনেক পুরাতন বলে বর্তমানে এর ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত।
৫. অন্যান্য ফ্রিজার
তরল নাইট্রোজেনের হিমায়িতকরণ তাপমাত্রা মাইনাস ১৯৬ ডিগ্রি সে.। তরল নাইট্রোজেন ব্যবহার করেও চিংড়ি/ মাছ হিমায়িত করা হয়। তাজা বা টাটকা চিংড়ি বা মাছ হিমায়িতকরণের সময় সৃষ্ট সমস্যাসমূহ-
ক) জারণের ফলে নষ্ট হওয়া;
খ) পানি বের হয়ে যাওয়া ;
গ) ভঙ্গুরতা বৃদ্ধি পাওয়া;
ঘ) অটোলাইসিসের সমস্যা;
ঙ) প্রোটিন ভেঙ্গে নষ্ট হয়ে যাওয়া; এবং
চ) আণুবীক্ষণিক জীবের সমস্যা ইত্যাদি।
ফ্রিজার বার্ন (Freezer burn): এয়ার ব্লাস্ট ফ্রিজারের ঠান্ডা বাতাসের গতিবেগ ৫০০ এফপিএম এর নিচে হলে চিংড়ির উপর একটি সাংঘাতিক ধরনের প্রভাব পড়ে। এ ধরনের ক্ষতিকর প্রভাবকে ফ্রিজার বার্ন বলে। এই অবস্থায় চিংড়ির পারিপার্শ্বিক বাষ্পের চাপ কমে যায়, ফলে চিংড়ির দেহ থেকে পানি বের হয়ে যেতে থাকে এবং চিংড়ি শক্ত হয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয়। এ ছাড়া চিংড়ির বর্ণ, গঠন ইত্যাদি নষ্ট হয়ে যায়। গ্রেজিং (Glazing) : এটি ফ্রিজার বার্ন থেকে চিংড়িকে রক্ষা করার একটি পদ্ধতি। চিংড়ির দেহ থেকে যাতে সহজে পানি বের হয়ে যেতে না পারে, সেজন্য এই প্রক্রিয়ায় চিংড়ির দেহের চারপাশে বরফের একটি আস্তরণ সৃষ্টি করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় খুবই অল্প সময়ের জন্য খুব নিম্ন তাপমাত্রায় জলীয় বাষ্প দ্রবণে চিংড়িকে ডোবানো হয়। ফলে চিংড়ির দেহের চারিদিকে বরফের একটি আস্তরণ পড়ে এবং চিংড়ির দেহ থেকে পানি বের হতে বাধা পায়। থইং (Thawing): থইং হলো হিমায়িতকরণের পরের একটি পরিচর্যা যাতে চিংড়ির দেহে কোথাও কোন বরফ থাকে না। এরুপ অবস্থা তখনই ঘটে যখন চিংড়ির দেহের সর্বত্রই তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সে. এর উপরে থাকে। |
চিংড়ি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে প্যাকেজিং এর গুরুত্ব
চিংড়ি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে প্যাকেজিং-এর গুরুত্ব অপরিসীম। চিংড়ি পণ্যকে বাতাসের আর্দ্রতা, পোকা- মাকড়, ধুলা- বালি ইত্যাদি থেকে রক্ষার জন্য অবশ্যই ভালভাবে প্যাকেজিং করা উচিত। ভাল প্যাকেজিং করে না রাখলে চিংড়ি পণ্যের গুণগতমান অতি দ্রুত নষ্ট হয়ে যাবে। স্বাস্থ্যসম্মত ও উন্নত চিংড়ি পণ্য তৈরি ও বাজারজাতের জন্য উন্নত প্যাকেজিং এর গুরুত্বসমূহ হলো-
ক) প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমে কোন দ্রব্যের মানের একটা প্রতিচ্ছবি ক্রেতা/বিক্রেতার নিকট ভেসে উঠে।
খ) প্যাকেজিংয়ের ধরন থেকে অতি সহজেই বুঝে নেয়া যায় পণ্যটি কত ভালভাবে সংরক্ষণ করা আছে বা সংরক্ষিত থাকবে।
গ) ভালভাবে প্যাকেজিং করা থাকলে বিক্রেতা পণ্যটি সুবিধামত স্থানে ও সুবিধামত সময়ে বিক্রয়ের জন্য সংরক্ষণ ও স্থানান্তর করতে পারে।
ঘ) ক্রেতাও সব সময় ভাল প্যাকেজিং করা পণ্য ক্রয় করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে।
প্যাকেজিংয়ে লেবেল ব্যবহারের গুরুত্ব:
ক) প্যাকেজিংয়ের লেবেলের মাধ্যমে কোন দ্রব্যের মানের একটা প্রতিচ্ছবি ক্রেতা/ বিক্রেতার নিকট ভেসে উঠে।
খ) প্যাকেজিংয়ের লেবেলের বর্ণনা থেকে অতি সহজে বুঝে নেয়া যায় পণ্যটির গুণগতমান, পুষ্টিগুণ ও এর মেয়াদ সম্পর্কে।
গ) ভালভাবে প্যাকেজিং ও লেবেলিং করা থাকলে ক্রেতা সব সময় পণ্য ক্রয় করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে।
ঘ) ট্রেসেবিলিটি লেবেল থাকলে পণ্যের পরিপূর্ণ ইতিহাস সহজেই জানা সম্ভব হয়।
প্যাকেজিং ও লেবেলিং এবং উৎপাদনকারী শনাক্তকরণ
ক) প্যাকেজিং ও লেবেলিং ঠিক থাকলে চিংড়ি পণ্যের গুণগত মানের জন্য উৎপাদনকারীকে দায়ী করা সম্ভব হয়।
খ) প্যাকেজিংয়ের লেবেল থেকে উৎপাদনকারীকে শনাক্ত করা যায়।
গ) উৎপাদনকারীকে শনাক্ত করা গেলে পণ্যের গুণগতমানের দায়ভার উৎপাদনকারীর ওপর বর্তানো সহজ হয়।
ঘ) যেহেতু ট্রেসেবিলিটি (traceability) লেবেল অর্থাৎ পরিপূর্ণ ইতিহাস রাখা আস্তে আস্তে বাধ্যতামূলক হতে যাচ্ছে, সেহেতু উৎপাদনকারীকে বা আরো নিচের দিকে চাষি বা হ্যাচারি মালিককেও শনাক্ত করা সম্ভব হবে।
ট্রেসেবিলিটি লেবেলে সাধারণত যে সকল তথ্য থাকা উচিত সেগুলো হলো-
ক) মা-চিংড়ি সম্পর্কিত তথ্য, যথা- ধরার তারিখ, ধরার প্রকৃতি ও ধরার পরে ব্যবহৃত খাদ্য/ ঔষধের বিবরণ
খ) সকল গৃহীত ব্যবস্থাদির তালিকা।
গ) চিংড়ি পোনা সম্পর্কিত তথ্য, যথা- হ্যাচিং এর তারিখ, ট্যাংকের নম্বর ও খাদ্য / ঔষধসহ গৃহীত ব্যবস্থাদির তালিকা।
ঘ) চিংড়ি চাষ সম্পর্কিত তথ্য, যথা- মজুদের তারিখ, পুকুর নম্বর ও খাদ্য / ঔষধসহ গৃহীত ব্যবস্থাদির তালিকা।
ঙ) চিংড়ি ডিপো/মধ্যবর্তী স্থান সম্পর্কিত তথ্য, যথা- ধরার / সংগ্রহের তারিখ, অবস্থানের মোট সময় ও গৃহীত ব্যবস্থাদির তালিকা।
চ) চিংড়ি ডিপো/মধ্যবর্তী স্থান সম্পর্কিত তথ্য, যথা- ধরার/সংগ্রহের তারিখ, অবস্থানের মোট সময় ও গৃহীত ব্যবস্থাদির তালিকা।
ছ) চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ সম্পর্কিত তথ্য, যথা- চিংড়ি গ্রহণের তারিখ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেজিং ও স্টোরেজসহ গৃহীত ব্যবস্থাদির বিস্তারিত তালিকা।
প্যাকেজিং ও লেবেলিংয়ের সহিত পণ্যের মান বাড়ার সম্পর্ক
ক) প্যাকেজিং ও লেবেলিং ঠিক থাকলে, লেবেলিংয়ে উৎপাদনকারীর পরিচয় থাকে ফলে উৎপাদনকারীর নিজস্ব দায় দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায় ও পণ্যের মান বাড়াতে সহায়তা করে।
খ) উৎপাদনকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত পণ্যের লেবেলে তাদের নাম ঠিকানা ব্যবহার করলে সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সুনাম রক্ষা করা ও ব্যবসায়িক সাফল্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধির জন্য তাদের উৎপাদিত পণ্যের মান বাড়াতে সদা সচেষ্ট থাকে।
স্বাস্থ্যসম্মত ও উন্নত চিংড়ি পণ্য তৈরি ও বাজারজাতের জন্য উন্নত প্যাকেজিং সরঞ্জাম হিসেবে পলিথিন জাতীয় সরঞ্জামের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ও জনপ্রিয়। তাছাড়া বিশ্বব্যাপী প্যাকেজিং সরঞ্জাম হিসেবে পলিথিনের ব্যবহারের সাথে সাথে পলিথিন সিলারের ব্যবহারের ব্যাপকতা বাড়ছে। বিভিন্ন প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রকার পলিথিন সিলারও এখন বাজারে পাওয়া যায়। পলিথিন জাতীয় সরঞ্জাম ব্যবহারের বেশ কিছু সুবিধা ও অসুবিধা আছে-
সুবিধাগুলোর মধ্যে রয়েছে-
ক) সহজপ্রাপ্যতা ও মূল্য কম হওয়া
খ) স্বচ্ছ ও অস্বচ্ছ উভয় প্রকার প্রাপ্যতা
গ) বিভিন্ন আকার ও প্রকৃতির প্রাপ্যতা
ঘ) লেবেল প্রিন্ট করার সুযোগ থাকা
ঙ) আর্দ্রতা প্রতিরোধক হওয়া
চ) টেকসই হওয়া
অসুবিধাগুলোর মধ্যে রয়েছে-
ক) পরিবেশবান্ধব না হওয়া।
খ) কোন সরু দ্রব্য, সূচ ও ধারালো জিনিস যেমন, চাকু, পিন ইত্যাদির সংস্পর্শে আসলে সহজেই ছিদ্র হওয়া বা কেটে যাওয়া।
গ) মজুদের সময় উপরে অবস্থিত প্যাকেটের পণ্যের চাপ সরাসরি নিচের প্যাকেটের পণ্যের উপর পড়ে।
পুনরায় ব্যবহারযোগ্য সাদা প্লাস্টিক পাত্রের ব্যবহার-
ক) পুনরায় ব্যবহারযোগ্য পাত্র হিসেবে প্রচলিত সাদা প্লাস্টিকের বৈয়মের ব্যবহার করা যেতে পারে।
খ) পরীক্ষামূলকভাবে বেশকিছু সাদা প্লাস্টিকের বৈয়মের ব্যবহার করে শুটকি বাজারজাত করে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া গেছে।
গ) চিংড়ি পণ্যের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার করতে হলে বৈয়মের আকার আকৃতি পরিবর্তন করে চিংড়ি পণ্যের উপযোগী করে তৈরি করতে হবে।
স্বাস্থ্য সম্মত ও উন্নত চিংড়ি পণ্য তৈরি ও বাজারজাতকরণ
স্বাস্থ্যসম্মত ও উন্নত চিংড়ি পণ্যের খবর ক্রেতার নিকট পৌঁছানো অতি জরুরি। চিংড়ি পণ্যের ভোক্তারা সাধারণভাবে চিংড়ি পণ্যের স্বাদের বিচার বিশ্লেষণ করে থাকে। চিংড়ি পণ্যের সকল ক্ষেত্রে হ্যাসাপ মেনে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তৈরি কিনা সে ব্যাপারে সচেতনতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
চিংড়ি পণ্য বাজারজাতকরণের বিভিন্ন পর্যায়েও গুণগতমান হারাতে পারে। চিংড়ি পণ্য বাজারজাত করার জন্য স্থানান্তরের সময় বা বাজারজাতের পরে বিক্রেতার দোকানে অসাবধানতার কারণে চিংড়ি পণ্যের প্যাকেট ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ও চিংড়ি পণ্যের গুণগতমান নষ্ট হতে পারে। দোকানে দীর্ঘ দিন অবিক্রিত রয়ে গেলে চিংড়ি পণ্যের গুণাগুণ নষ্ট হতে পারে। কাজেই বাজারজাতকরণের সময়ে ও তৎপরবর্তী বিক্রয়ের সময়ে বিশেষভাবে চিংড়ি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করা অপরিহার্য। তাছাড়া স্বাস্থ্যসম্মত চিংড়ি পণ্যের খবর অতি দ্রুত ক্রেতার নিকট পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য দেশে ও বিদেশে চিংড়ি পণ্য বিপণনে বিজ্ঞাপন প্রচারসহ মেলা বা প্রদর্শনীর আয়োজন করা যেতে পারে।
হ্যাসাপ (HACCP) ভিত্তিক মৎস্য ও চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প কারখানার মান নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব : বিগত কয়েক দশকে উন্নত বিশ্বের দেশসমূহে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে চিংড়ি রপ্তানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। রপ্তানিকৃত মৎস্যজাত খাদ্যের প্রধান শর্ত হলো গুণগত মানসম্পন্ন হওয়া। ১৯৯০ এর শুরুতে হ্যাসাপ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চিংড়িজাত খাদ্যের মান উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এ পদ্ধতি প্রয়োগ করলে মৎস্যজাত খাদ্যে যে জীবাণুগত সমস্যা এবং নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে তা মান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গুণগত মানসম্পন্ন খাদ্যসামগ্রী বিশ্বে বাজারজাত করা সহজ হবে। এই হ্যাসাপ পদ্ধতি বাস্তবায়নের ফলে প্রায় ১০০ ভাগ খাদ্যসামগ্রীকে অণুজীবঘটিত রোগের সংক্রমণ থেকে রোধ করা সম্ভব। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় যে বিশ্বের মোট খাদ্য উৎপাদনের শতকরা ৫ ভাগ খাদ্য ভোক্তাদের কাছে পৌঁছার আগেই নষ্ট হয়ে যায়। এই প্রেক্ষিতে সুদীর্ঘ গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা একমত পোষণ করেন যে, খাদ্য উৎপাদনের উৎস্যস্থল থেকে যে সকল কারণে খাদ্য সংক্রমিত হচ্ছে তা নিরীক্ষা এবং নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভোক্তাদের নিরাপদ স্বাস্থ্য এবং সুন্দর জীবন উপহার দেয়া সম্ভব।
চিংড়ির উত্তম ব্যবস্থাপনা
খাদ্য যাতে স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ না হয় এবং খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ্যে প্রক্রিয়াজাতকরণ সংস্থা হ্যাসাপ পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে গুণগতমান উন্নয়ন করে থাকে। ভালো প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি বা GMP (Good Manufacturing Practice) এর মাধ্যমে গুণগত মানসম্পন্ন খাদ্য ভোক্তার কাছে গ্রহণযোগ্যতার জন্য প্রয়োজন হয়। GMP এর অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করে বাস্তবায়ন করতে হয় যা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির মাধ্যমে স্থায়ীভাবে পণ্য সামগ্রী ভোক্তার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকে। আবার কার্যকর বা ফলপ্রসূ বলতে আমরা বুঝি পণ্যসামগ্রীটি স্বাস্থ্যসম্মত হওয়া সত্ত্বেও কিছু কিছু অণুজীব কণা খাদ্যে থেকেও যেতে পারে যা সম্পূর্ণভাবে নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হ্যাসাপ
হ্যাসাপ হলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি বিধি-বিধান, যা কোন খাদ্য সামগ্রী উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, গুদামজাতকরণ, বিপণন ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে বাধ্যতামুলকভাবে মেনে চলতে হবে। বাংলাদেশের মূল্য সংযোজিত চিংড়ি পণ্যের প্রধান ক্রেতা হলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। এ সকল দেশের মূল্য সংযোজিত চিংড়ি পণ্য আমদানির প্রধান শর্ত হচ্ছে পণ্য উৎপাদনের সর্বস্তরে হ্যাসাপ-এর বিধিবিধান বাধ্যতামূলকভাবে মেনে চলা। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে রপ্তানির উদ্দেশ্যে রপ্তানিকারক চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকারী কারখানাগুলোতে হ্যাসাপ বিধি-বিধান মানা হচ্ছে।
হ্যাসাপ এর প্রধান দিকগুলো হল মানুষ বা অন্য কোন জীব বা সামগ্রিকভাবে পরিবেশের উপর বিরুপ প্রভাব পড়ে এমন কোন ক্ষতিকারক উপাদান বা কার্যক্রম প্রতিহত করা বা সম্ভব না হলে যতদূর সম্ভব কমানো। যে সকল উপাদান বা কার্যক্রম ক্ষতির কারণ হতে পারে তাদেরকে হ্যাজার্ড বলে। হ্যাজার্ডসমূহকে নিয়ন্ত্রণের জন্যই সকল বিধি-বিধান আরোপ করা হয়েছে। হ্যাজার্ডসমূহকে প্রধানত নিম্নলিখিতভাবে ভাগ করা যায়-
ক. জৈবিক হ্যাজার্ড: ক্ষতিকারক অণুজীব, বিশেষ করে মানুষের রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাক্টেরিয়া বা অন্যান্য অণুজীবের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই মূলত প্রাথমিকভাবেই হ্যাসাপের প্রবর্তন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে আরো অন্যান্য দিক সংযোজিত হয়ে হ্যাসাপের কলেবর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত জৈবিক হ্যাজার্ড সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। জৈবিক হ্যাজার্ড আবার বিভিন্ন পণ্যের জন্য বিভিন্ন হয়ে থাকে। হিমায়িত পণ্যের জন্য এক রকম, কৌটাজাত পণ্যের জন্য অন্য রকম বা খাবার উপযোগী পণ্যের জন্য সেটা ভিন্ন রকম। চিংড়ি বা মাছের পরজীবী, যথা- নেমাটোডস (গোল কৃমি), সেসটোডস (ফিতা কৃমি), ট্রেমাটোডস (ফ্রুকস) ইত্যাদির উপস্থিতিও এক ধরনের জৈবিক হ্যাজার্ড।
খ. রাসায়নিক হ্যাজার্ড: ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ, যেমন- এন্টিবায়োটিক ও কীটনাশকই বাংলাদেশী মৎস্য পণ্যের জন্য বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা। কিছু কিছু ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ উচ্চ তাপমাত্রায় মাছ বা চিংড়ির দেহ পচনের ফলে তৈরি হয়। ঐ সমস্ত রাসায়নিক পদার্থকে স্কমব্রো টক্সিন বা হিস্টামিন ফরমেশন বলে, ফলে ঐ সমস্ত চিংড়ি বা মাছ খেলে এলার্জি জনিত কারণে বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। এন্টিবায়োটিক সাধারণত প্রক্রিয়াজাতকারীরা ব্যবহার করেন না। এন্টিবায়োটিক সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় হ্যাচারি ও চিংড়ি চাষের খামারে। মাছের ট্রলার থেকে চিংড়ি আহরণ করে প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় আনার সময় রাসায়নিক দ্রব্য কিংবা ডিজেলের মিশ্রণের ফলেও চিংড়ির মান ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
গ. ফিজিক্যাল হ্যাজার্ড: ক্ষতিকারক কোন বস্তু, যেমন- আলপিন, পেরেক, কাঁচের ভাঙ্গা টুকরা ইত্যাদি হ্যাজার্ডকে ফিজিক্যাল হ্যাজার্ড বলে। প্রক্রিয়াজাতকরণের বিভিন্ন পর্যায়ে এ সমস্ত ক্ষতিকারক বস্তুর সংমিশ্রণের সম্ভাবনা থাকে।
ঘ.পরিবেশগত হ্যাজার্ড: পরিবেশের জানা ক্ষতিকারক বস্তু বা কার্যক্রম, যেমন- ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করে চিংড়ি চাষ বা মাছ চাষ, কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পানির দূষণ ইত্যাদি হ্যাজার্ডকে পরিবেশগত হ্যাজার্ড বলে।
চিংড়ি দূষণের উৎস শনাক্তকরণ
নিম্নলিখিত উৎস থেকে চিংড়িতে দূষণ হতে পারে-
ক) সংক্রমণযুক্ত মা চিংড়ির ব্যবহার।
খ) সংক্রমণযুক্ত লার্ভি/পিএল ব্যবহার।
গ) চাষের জলাশয় বা তার আশপাশের পরিবেশ থেকে সংক্রমণ।
ঘ) চিংড়ি চাষের সময় খাদ্য/ ঔষধ ইত্যাদি থেকে সংক্রমণ।
ঙ) চিংড়ি আহরণের ও বাজারজাতকরণের যে কোন পর্যায়ে সংক্রমণ।
চিংড়ির দূষণের উৎস থেকে মুক্ত হওয়ার উপায়
ক) কোন প্রকার ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ বা অণুজীব দ্বারা সংক্রমিত হলে সেই মা-চিংড়ি কোন অবস্থাতেই চিংড়ির পোনা তৈরির জন্য হ্যাচারিতে ব্যবহার করা চলবে না।
খ) হ্যাচারিতে ব্যবহারের জন্য এমন মা-চিংড়ি ব্যবহার করতে হবে যাহা নিশ্চিতভাবে কোন ক্ষতিকর রাসায়নিক বা অণুজীব দ্বারা সংক্রমিত নয়।
গ) চিংড়ি চাষের জন্য ব্যবহৃত লার্ভি/পিএল অবশ্যই সর্বপ্রকার ক্ষতিকর রাসায়নিক বা অণুজীব দ্বারা কোন পর্যায়ে সংক্রমিত নয় তা নিশ্চিত হতে হবে।
ঘ) চিংড়ি চাষের জন্য পিএল নির্বাচনের পূর্বে নিশ্চিতভাবে পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে জানতে হবে যে চাষের জন্য নির্বাচিত পিএল সর্বপ্রকার ভাইরাসমুক্ত।
ঙ) চিংড়ি চাষ করতে গিয়ে তার আশেপাশের কোন জলাশয় বা পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না বা আশেপাশের কোন জলাশয় বা পরিবেশ থেকে কোন ক্ষতিকর বস্তুর জলাশয়ে প্রবেশ রোধ করতে হবে।
চ) চিংড়ি চাষের জলাশয় থেকে বা তার আশপাশের পরিবেশ থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বা অণুজীব দ্বারা সংক্রমিত নয় সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
ছ) চাষের সময়ে চিংড়িকে যে খাদ্য দেয়া হয় বা যে ঔষধ প্রয়োগ করা হয় তা থেকেও চিংড়িতে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বা অণুজীব সংক্রমিত হতে পারে। সেজন্য চিংড়ি চাষের সময় খাদ্য/ ঔষধ ইত্যাদি থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বা অণুজীব দ্বারা সংক্রমিত নয় সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
জ) চিংড়ি চাষের পর আহরণের ও বাজারজাতকরণের সময়েও বিভিন্ন প্রকার ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বা অণুজীব দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে। সেজন্য চিংড়ি আহরণের ও বাজারজাতকরণের কোন পর্যায়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বা অণুজীব দ্বারা সংক্রমিত নয় সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
হ্যাচারি ও চিংড়ি চাষে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থসমূহ
১. মিথিলিন ব্লু (Metheline blue ) ।
২. ট্রাফলান (Treflan )
৩. প্রোটোজোয়াসাইড (Protozoacide)
৪. ফরমালিন (Formalin )
৫. জুথামনিসাইড (Zoothamnicide)
৬. ব্লিচিং পাউডার (Bleaching powder)
৭. কপার সালফেট (Copper sulfate)
৮. ম্যালাকাইট গ্রীন (Malachite green) ইত্যাদি
হ্যাচারিতে ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিকসমূহ
১. সিপরোফ্লোক্সাসিন (Ciprofloxacin)
২. স্ট্রেপটোমাইসিন (Streptomycin)
৩. কেনামাইসিন (Kanamycin)
৪. ইরাইথ্রোমাইসিন (Erythromycin)
৫. অক্সিটেট্রাসাইক্লিন (Oxytetracycline)
৬. অক্সোলিনিক এসিড (Oxolinic acid)
৭. অ্যালবাজিন (Albazin)
নিষিদ্ধ এন্টিবায়োটিকসমূহ
১. ক্লোরামফেনিকল (Chloramphenicol
২. নিওমাইসিন (Neomycin)
৩. নাইট্রোফিউরান মেটাবোলাইট (Nitrofuran metabolite )
কার্যকর এন্টিবায়োটিকসমুহ
Erythromycin, Ciprofloxacin etc.
অকার্যকর এন্টিবায়োটিকসমূহ
Chloramphenicol, Nalidixic acid, Amoxicillin, Kanamycin, Neomycin, Ampicillin cte.
নিষিদ্ধ এন্টিবায়োটিকের ব্যবহারে ক্ষতিকর প্রভাবসমূহ
ক. জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব
১) মানবদেহে নানা রকম ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে পৃথিবীর অনেক দেশে এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার কমে গেছে, অনেক এন্টিবায়োটিক নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
২) কেবলমাত্র প্রয়োজন হলেই চিংড়ির রোগ সৃষ্টিকারী নির্দিষ্ট ব্যাক্টেরিয়া ধ্বংস করতে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা উচিত।
৩) প্রায়শই দেখা যায় যে, সমস্যা সৃষ্টিকারী ব্যাক্টেরিয়া শনাক্ত না করেই এবং কোন ধরনের এন্টিবায়োটিক সেনসিটিভিটি (sensitivity) পরীক্ষা ছাড়াই এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে।
৪) এন্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে বিভিন্ন ব্যাক্টেরিয়ার এন্টিবায়োটিকের প্রতি রেজিস্ট্যান্স (resistance) সৃষ্টি হচ্ছে। এন্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার হ্যাচারি কর্মীদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির কারণ হচ্ছে, মানবদেহেও ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স তৈরি হচ্ছে।
জলজ জীবের ওপর প্রভাব
১) হ্যাচারি ও চিংড়ি চাষে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থের বর্জ্য জলজ পরিবেশ ও সমুদ্রে যায়, যা পানি দূষণ সৃষ্টি করে থাকে।
২) পানি দূষণের মাধ্যমে জলজ অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও প্রজনন মারাত্মকভাবে ব্যহত করে, এমনকি মৃত্যুরও কারণ হতে পারে।
চিংড়ি রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রভাব
৩) চিংড়ি উৎপাদনের কোন পর্যায়ে নিষিদ্ধ এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করলে এবং চিংড়ির মাংসপেশীতে এন্টিবায়োটিকের অবশিষ্টাংশ (residue) থাকলে সেই চিংড়ি পণ্য রপ্তানি করা যাবে না।
৪) আমদানীকারক বিভিন্ন দেশ থেকে এ অসাবধানতার কারণে প্রায়ই চিংড়ি কন্টেইনার দেশে ফেরৎ আসে।
আরও দেখুন...